বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী জনপদ সন্দ¡ীপ। মোঘল আমল বা তারো আগে থেকে এখানে জনবসতি গড়ে ওঠার ঐতিহাসিক প্রমাণ বিদ্যমান। এর মধ্যে বহু নামকরা পরিবার বংশ পরম্পরায় বাস করে আসছে। ক্রমাগত ভাঙনের ফলে বহু বংশ পরিবার বারবার সন্দ¡ীপের ভেতরে ও বিশেষ করে বাইরে স্থানান্তরিত হয়েছে। সীতাকুন্ড, মীরসরাই, নোয়াখালী, চাঁদপুর, ভোলা বা চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকাসহ দেশে বিদেশে এ স্থানান্তর অব্যাহত রয়েছে।
হাজী ওয়াসিল মালাহাদারের পরিবার এমনই একটি ঐতিহ্যবাহী পরিবার। ১৮৬০ সালের দিকে বাটাজোড়া গ্রামে একজন জমিদার হিসেবে বিশাল এলাকায় নিয়ে মুক্তারপুর গ্রাম থেকে এসে বসতি স্থাপন করেন। তাঁর পুত্র ও পৌত্রগণ পাকিস্তান আমলে জমিদারী প্রথা বিলোপ পর্যন্ত বিপুল ঐশ¡র্যময় জীবনযাপন করে গেছেন। বিংশ শতাব্দীর সত্তুরের দশকে বাটাজোড়া গ্রাম বিলুপ্ত হলে পরবর্তী বংশধররা দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়েন।
এই সুযোগ্য বংশধরগণ তাঁদের বংশের প্রামাণ্য ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেছেন। জনাব মোশারেফ হোসেন জগলুর সম্পাদনায় ২০২০ সনের ডিসেম্বরে ’শিকড়’ বই চট্টগ্রাম থেকে বের হয়েছে। কয়েক বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমে এই বংশের অতীত ও বর্তমান প্রজন্মের বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁদের প্রতিষ্ঠা লাভের বিবরণ দেয়া হয়েছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ, প্রশাসন, ডাক্তার/প্রকৌশলীর মতো নানান রকম পেশায় থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত তাঁদের অর্জন অতুলনীয়।
বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠির অতীত ইতিহাসে প্রামান্য তথ্যের অভাব খুবই চোখে পড়ে। বিশেষ করে মধ্যযুগ বা উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত নামকরা বংশ বা ব্যক্তিত্বের বিস্তারিত ইতিহাস একেবারেই অপ্রতুল। এ বইয়ে দিদারুল আলমের ভাষায় সে হাহাকারই সুন্দর করে ধরা পড়েছে- ’’সম্ভবত চাচা জেঠারা জানতেন। তখন কৌতুহল না হওয়ায় তাদের কাউকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হয়নি। আজ যখন কৌতুহল জাগছে, তখন জিজ্ঞেস করার জন্য তাঁদের কেউ আর জীবিত নেই’’ (পৃ-৩২১)। আমার নিজের বংশের বিষয়েও আমি একই হাহাকারে পর্যুদস্ত।
ওয়াসিল মালাহাদার (১৮৩৫-১৯১০) কিভাবে প্রচুর ভূ-সম্পত্তির অধিকারী হন সে বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা দেয়া সম্ভব হয়নি। তবে তাঁর বংশধরগণ মুসলিম রেনেসায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অবদান রেখেছেন এতে কোন সন্দেহ নেই। তাঁর বড় ছেলে সন্দ¡ীপ মোসলেম এসোসিয়েশনের প্রথম সদস্য ছিলেন। এটি ১৯২৯ সালের কথা। সন্দ¡ীপ হাইস্কুল প্রতিষ্ঠায় এই এসোসিয়েশনের ভূমিকা অনন্য ছিল। ’৭০ বর্ষে সন্দ¡ীপ মডেল হাইস্কুল (১৯৩৩-২০০৩)’ (২০০৪) বইয়ে বিশিষ্ট ঐতিহাসিক এবিএম সিদ্দিক চৌধুরী এ বিষয়ে বিস্তারিত বলে গেছেন। তবে ’শিকড়’ বইয়ে এ নিয়ে কোন তথ্যসূত্র উলেখ করা হয়নি। এছাড়া বিভিন্ন পারিবারিক বা অন্যান্য তথ্য যেগুলোর পূনর্মুল্যায়ণ প্রয়োজন তা সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো।
হাজী মোয়াজ্জেম হোসেন ১৯১৭ সালে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে পড়ার সময় অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন। কিন্তু অসহযোগ আন্দোলনে শুরু হয়েছিল ১৯২০ সালে।
১৯২৮ সালে নজির আহাম্মদ মিয়া বিয়ে করেন কাঠগড়ের জমিদার আবুল হোসেন চৌধুরীর মেয়ে চেমন আফরোজকে। সেলিনা চৌধুরীর তথ্যমতে তিনি প্রথম স্ত্রীর কন্যা ছিলেন। আবার আবুল হোসেন চৌধুরী দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলেন আমিরাবাদ গ্রামের গোলাম রসুলের মেয়ে চেমন আফরোজকে। (স¥ৃতির কলোলে-সন্দ¡ীপে গোলাম নবী পন্ডিতের বংশধারা, পৃ-২০)।
হাসমত আলী মিয়ার ছেলে মোস্তাফিজুর রহমান কলকাতা আলীগড় বিশ¡বিদ্যালয় থেকে এমএ, এলএলবি পাশ করেন। কিন্তুু আলীগড় বিশ¡বিদ্যালয় ভারতের উত্তর প্রদেশে অবস্থিত।
বাদশা আলম মিয়া কোন ইউনিয়নের পে্িরসডেন্ট ছিলেন? বইয়ের ২৬৩নং পৃষ্ঠায় কালাপানিয়া ও ২৮৪ নং পৃষ্ঠায় বাটাজোড়ার কথা উলেখ আছে। তিনি ১৯২৮ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ালেখা শেষ করে সন্দ¡ীপ চলে আসেন। কবি নজরুলের সাথে কি তাঁর কোন স¥ৃতি ছিল? কারণ মুসলিম জাগরণের ঢেউ ততদিনে শুরু হয়ে গেছ। ১৯২৯ সালে নজরুল সন্দ¡ীপ এসেছিলেন। সন্দ¡ীপ টাউন, কমরেড মুজাফফর আহমদের বাড়ি ছাড়াও চরবদু ও জমিদার আবুল হোসেন মিয়ার বাড়িতে বেড়ানোর সময় (দ্বীপের চিঠি-৭, ২০১৪) সংস্কৃতিমনা বাদশা আলম মিয়ার স¥ৃতি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে থাকাই স্বাভাবিক ছিল।
সন্দ¡ীপের ভাঙ্গন আমাদের নিত্য অভিজ্ঞতা। ১৯৭৪ সালে চট্টগ্রামের হালিশহরে শেখ নুরুল ইসলাম মিয়ার সভাপতিত্বে সন্দ¡ীপ নদী সিকস্তি কল্যাণ সমিতি গঠিত হয়। এ সমিতির কাজের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিলে ভালো হতো।
বীর মুক্তিযোদ্ধা রেজ্জাকুল হায়দার এ বংশের গৌরব বৃদ্ধি করেছেন। তিনি সন্দ¡ীপে কোন ঘাট থেকে রওনা দেন? ভারতের কোন জায়গায় প্রশিক্ষণের জন্যে অপেক্ষায় ছিলেন? শহীদ স্বপনের পুরো নাম কি ছিল? যুদ্ধের আরো বিস্তারিত বিবরণ দিলে ভালো হতো। কারণ একসময় ইতিহাস ওনাদেরকেই খুঁজবে, আমাদেরকে নয়।
জনাব ফজলুল হক ঋণ সালিশী বোর্ডে কর্মরত ছিলেন। যদিও নিজেদের বিরুদ্ধে, তবু তখনকার সময়ে এ বোর্ডের কাজ ভবিষ্যতে আরো বিস্তারিত তুলে ধরবেন বলে আশা করি। বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন উইকিপিডিয়া থেকে নেয়া হয়েছে। একইভাবে সূর্যাস্ত আইনের তথ্যসূত্র দিলে ভালো হতো।
বলা হয়েছে ১৭৭২ সালে মি. র্যানেল সন্দ¡ীপের ম্যাপ অংকন করেন (পৃ-১৭৮)। তবে সন্দ¡ীপের ইতিহাস সমাজ ও সংস্কৃতি (১৯৮৭) বইয়ের তথ্যমতে ১৬৫২ সালের ম্যাপেও সন্দ¡ীপের অস্তিত্ব দেখা যায়। তবে এটা ঠিক, মিঃ র্যানেলই প্রথম বিস্তারিত ম্যাপ অংকন করেন।
ব্রিটিশ আমলে সন্দ¡ীপ কত সালে নোয়াখালীর অন্তর্ভূক্ত হয় দু জায়গায় (পৃঃ-১৭৫/পৃ-২৭৯) দুরকম তথ্য দেয়া হয়েছে (১৮২১/১৮৭৭)।
বইয়ে এ বংশের সাথে যুক্ত বিভিন্ন ব্যক্তিত্বের জীবনীর তথ্যসূত্র উলেখ করলে ভালো হতো। সাহেবানী মসজিদের (পৃ-৩৮৫) প্রতিষ্ঠাকাল বলা হয়েছে ১৬৩৪। এ নিয়ে বিভিন্ন তথ্য বিদ্যমান। ছোট বেলায় আমি নিজে এ স্থাপনাকাল ১১৫৫ হিজরী দেখেছিলাম। সে মোতাবেক ১৭৪২ সাল হয়।
’সন্দ¡ীপ সড়কের’ ইতিহাস অনেক কিছুই মনে করিয়ে দেয়। বাড়ীর সামনে বাজার / বাটাজোড়া জুনিয়র মাদ্রাসা / বাটাজোড়া হাই স্কুল / পোস্ট অফিস / কবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল (পৃ-২৩২)? মিয়া বাড়ির পুকুরে সবাই মিলে কিভাবে মাছ ধরা হতো? সন্দ¡ীপে প্রথম রাইস মিল কবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল? ১৯৫৫ সালের এশিয়াটিক কলেরায় এ বাড়ির কত জনের মৃত্যু হয়েছিল?
তখনকার দিনে ধনাঢ্য পরিবারে বিয়ে সাদি খুব ধুমধামে অনুষ্ঠিত হতো। এরকম যে কোন একটি বিয়ের বর্ণনা দিলে ভালো হতো।
এ বইয়ের অনন্য সংযোজন পারিবারিক বন্টন নামা, খাজনার রশিদ, খতিয়ান, মামলার অনুলিপি, ১৯৩৯ সনের কলকাতা বিশ¡বিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট, পুরনো চিঠি, হাতের লেখা, স্বাক্ষর, বাটাজোড়া মিয়া বাড়ির নকশা ইত্যাদি। এক সময় কাড়ি কাড়ি রুপার টাকা জমা হতো। যদিও নদী ভাঙনের অনেক কিছুই হারিয়ে গেছে, তবু সেই শৈল্পিক হুক্কা, রুপার টাকা, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের স¥ারক, প্রাচীন অলংকার, তৈজসপত্রসহ বিভিন্ন দূর্লভ সামগ্রীর স¥ৃতি কি কারো কাছে নেই? থাকলে এ সংযোজন আরো সমৃদ্ধ হতো। ইচ্ছে করলে এসব পারিবারিক সংগ্রহ দিয়ে একটি যাদুঘর করা যায়। দেলোয়ার হোসেনের ডায়েরি থেকে অনেক তথ্য নেয়া হয়েছে কিন্তু ওনার ডায়েরীর অন্তত একটি পাতার স্ক্যান দিলে এর ঐতিহাসিক মূল্য আরো বৃদ্ধি পেতো। বেশ পুরনো কিছু ছবি দেয়া হয়েছে, কিন্তুু কার ক্যামেরায় তোলা বলা হয়রিন। কারণ তখন পুরো গ্রামে হাতে গোনা দুয়েকটা সংগ্রহ পাওয়া যেতো। চিঠির পরিচিতিতে ’আমার জেঠা’ / ’আমার কাকা’ না দিয়ে ব্যক্তির নাম দিলে ভালো হতো। কারণ বইটি এ বংশের সবার সম্পদ।
মালাহাদার বাজার এলাকা একটি উপশহরের মতো ছিল। এ বাজার বা স্কুলকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড যেমন-নাটক/দেয়াল পত্রিকা ইত্যাদি বের হতো কিনা? নুরুল ইসলাম মিয়া কলকাতা মাদ্রাসা থেকে কবে এন্ট্রান্স পাশ করেন? কবে দুবার ঈদের নামাজ হয়েছিল? অনেকে বাল্যকালের মধুর স¥ৃতি উলেখ করেছেন কিন্তুু সময়কাল উলেখ করেননি।
একই বংশের সবার ধারা পরবর্তী প্রজন্মে সমানভাবে বিকশিত হয় না। মানব সভ্যতার এটাই চিরন্তন সত্য। প্রয়োজনের সময় সহায়তার জন্য একে অপরের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়ার সামাজিকতা এ বংশে চালু আছে। এর মাঝে একজন যাকাত ফান্ড গঠনের প্রয়োজনীয়তাও উলেখ করে সমাািজক দায়িত্ববোধের পরিচয় দিয়েছেন।
জনাব মোহাম্মদ মোশারেফ হোসেন জগলু একজন ইতিহাস অনুসন্ধিৎসু ব্যক্তিত্ব। ইতিহাসকে তুলে ধরায় তাঁর স্বতস্ফূর্ত প্রচেষ্টা প্রশংসনীয়। সামাজিক বিবর্তনের দলিল হিসেবে এ বইটি সর্বত্র প্রশংসা পাবে বলে মনে করি।
যে কেউ সামাজিক সমীক্ষার উপর পিএইচডি ডিগ্রী করতে চাইলে এ বই থেকে পর্যাপ্ত তথ্য সহজেই পেয়ে যাবেন। কয়েক বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমে তাঁরা যে অসাধ্য সাধন করেছেন তা সন্দ¡ীপসহ যে কোন প্রান্তিক জনপদের ইতিহাস রচনায় পাথেয় হিসেবে পথ দেখাবে বলে আমার দৃঢ় বিশ¡াস।