সামছুদ্দীন আজাদ-সহ্্-সভাপতি, যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামীলীগ।
বঙ্গোপসাগরের মোহনায় অর্থাৎ সাগর তীরের একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ সন্দ্বীপ। তিন হাজার বছরের বেশী এই পুরানা দ্বীপ আজ সাগর গর্ভে বিলীন হয়ে ৪০০ শত বর্গমাইল থেকে এসে মাত্র ৯০ বর্গমাইলে এসে দাঁড়িয়েছে। প্রকৃতির এমন বৈরী আচরনের সাথে কষ্ট সহিষ্ণু সন্দ্বীপবাসী জীবনের কোন পর্যায়ে থেমে যায় নি। বরং প্রকৃতির এমন বৈরীতা তাদেরকে প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে জীবন সংগ্রামে টিকে থাকার অনুপ্রেরনা যুগিয়েছে। তাই রাজনীতির মাঠে, সাংস্কৃতিক অঙ্গনে, সরকারী-বেসরকারী চাকুরীতে, ব্যবসা বানিজ্যে, ক্রীড়া অঙ্গনে, শিক্ষা দীক্ষায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায়, গবেষণায়, চিকিৎসা জগতে, সরকারী কর্মকমিশনে, বিচারালয়ে জীবনের এমন কোন অঙ্গন বাকী নেই যেখানে সন্দ্বীপের মেধাবী সন্তানেরা তাদের মেধার স্বাক্ষর রাখেনি। আর যারা দেশে টিকে থাকতে পারেনি জীবন জীবিকার তাগিদে দেশান্তরি হয়েছেন তারাও স্ব স্ব ক্ষেত্রে সফলতার স্বাক্ষর রেখেছেন। আমি দেখেছি ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর দেশ স্বাধীনের আগে মানুষের আর্থিক অবস্থা কোন পর্যয়ে ছিল। নিতান্ত গৃহস্থী, হালচাষ করাটাই ছিল সন্দ¦ীপ তথা সারা বাংলাদেশের মানুষের পেশা। এরপর দ্বিতীয় পেশা ছিল প্রাইমারী ও হাইস্কুলের শিক্ষকতা। স্বাধীনতার পর পর স্বাধীন বাংলাদেশের সাথে যখন সারা পৃথিবীর সাথে কুটনৈতিক সর্ম্পক তৈরী হল, বাংলাদেশের স্বীকৃতি মিললো, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সদস্য পদ লাভ করলো এবং সেই সাধারণ পরিষদের ১৯৭২ সালের অধিবেশনে জাতির পিতা বাংলা ভাষায় ভাষন দিয়ে বাংলাদেশকে যেমন সারা বিশ্বে পরিচিত করে দিলেন তেমনি বাংলা নামক ভাষাকেও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিত করে দিয়ে গেলেন। সেই থেকে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা যেমন থেমে থাকেনি একইভাবে সন্দ্বীপবাসীও তাদের ভাগ্যান্বেষনেও বিশ্বের দেশে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে গেল। স্বাধীনতার পর পর সন্দ্বীপবাসীর বেশিরভাগ মধ্য প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে যাওয়ার সুযোগ পেল বলতে গেলে তখন এমন কোন বাড়ী বাকী ছিল না যে বাড়ীর একজন লোক অন্তত মধ্য প্রাচ্যে যাই নি। কালক্রমে রাষ্ট্রের সাথে রাষ্ট্রের কুটনীতিক সম্পর্কের কারনে বাংলাদেশের অবস্থা সুদৃঢ় হল আর্ন্তজাতিক অঙ্গনে। আমাদের ওয়েজ আর্নারেরা দক্ষ হয়ে গড়ে উঠলে কর্মক্ষেত্রে সততার পরিচয় মিললো তখন সন্দ্বীপীরা এশিয়া আফ্রিকা, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যাওয়া শুরু করলো। সর্বোপরি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও সন্দ্বীপবাসীর এক বিশাল অংশ স্থায়ী আবাসন গড়ে তুলে ফেলেছে। স্বাধীনতার পূর্বে আমরা যখন পাকিস্থানের প্রদেশ অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্থানের নাগরিক ছিলাম তখন সেই সুযোগ আমরা পায়নি এমনকি কল্পনাও করতে পারিনি। কিন্তু পাকিস্থানীরা বরাবরই ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগষ্ট স্বাধীনতা লাভের পর থেকে আমেরিকা আসা শুরু করেছে যা এখানে এসে দেখলাম। পাকিস্থানীরা এই যুক্তরাষ্ট্রে কতবেশী সংখ্যক মানুষ রয়েছে এবং তারা কতবেশী শক্তিশালী, কত বেশী অর্থবিত্তে সুসংহত। আর আমরা বাঙ্গালীরা সেই সুযোগ পেলাম আমাদের স্বাধীনতার পর অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পর , মানে ২৪ বছর পর, দীর্ঘ ৪৭ বছরে অনেক সন্দ্বীপবাসী যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমিয়েছে ২/১ জন তারও আগে এসেছে বলে আমরা জেনেছি। তারা তখন পাকিস্থান আমলে জাহাজের নাবিক হিসাবে কাজ করার সুবাদে আমেরিকায় থেকে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে গেছেন। পর্যায় ক্রমে তারা বৈধতা পেয়েছেন গ্রীনকার্ড পেয়ে পরে মার্কিন নাগরিকত্বও লাভ করার কারনে আমেরিকান ইমেগ্রেসন আইন অনুযাযী রক্তের সম্পর্কিত স্বজনদের আমেরিকা আনার অনুমতি পেয়ে নিজের স্ত্রী-ছেলেমেয়ে, ভাই-বোনদের আমেরিকা নিয়ে আসার সুযোগ পেয়ে গেলেন। আজ নিউইয়র্ক সহ্ সারা যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি অঙ্গরাজ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রায় (২০) বিশ হাজারের অধিক সন্দ্বীপী যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছে। বিশেষ করে নিউইয়র্কে ষ্টেটের ইৎড়ড়শষুহ নড়ৎড়ঁময তে সবচেয়ে বেশী সংখ্যক সন্দ্বীপবাসীর বসবাস। সন্দ্বীপের বেশির ভাগ লোক এখানে ইমেগ্রেন্ট হয়ে আসছে, বাবা, মা অথবা ভাই বোনের এর মাধ্যমে। প্রথমে এখানে ইমেগ্রেশানের কড়াকরীর এর কারনে মানুষের অবস্থা খুব খারাপ ছিল। বেশিরভাগ লোক ছিল অবৈধ, গ্রীনকার্ড ছিল না, এক একজন একনাগাড়ে ২০/৩০ বছর পর্যন্ত কাগজপত্রহীন থেকে গেছে। কালক্রমে মানুষ এসব সমস্যা কেটে উঠেছে ইমেগ্রেশন এর শিথলতার কারনে। বলতে গেলে এখন মানুষ খুব স্বাভাবিক জীবনযাপন করছে এখানে। কারো কোন সমস্যাই নাই। পর্যায় ক্রমে সন্দ্বীপবাসী নিউইয়র্কের সিটিতে তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করেছে। অর্থ বিত্তে, ব্যবসা বাণিজ্যে সন্দ্¦ীপবাসী অনেকদূর এগিয়েছে। এ প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা এখানে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে লিখা পড়া শেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন জায়গায় ভালভাবে চাকুরী করছে। এখানে সন্দ্বীপবাসী গড়ে তুলেছে সামাজিক সংগঠন, সাংস্কৃতিক সংগঠন। এখানে সবচেয়ে আদি সামাজিক সংগঠন হচ্ছে- সন্দ্বীপ এসোসিয়েশান উত্তর আমেরিকা। কাালসারাল অরগানাইজেশন সন্দ্বীপ ইডুকেশন এন্ড কালচারাল সোসাইটি। যেটির বর্তমান সভাপতিও আমি নিজে। পর্যায়ক্রমে রাজনৈতিক কারনে সন্দ্বীপবাসী বিভক্ত হয়ে পড়লে পাল্টা সংগঠন তৈরী করে নিজেরা নিজেদের মধ্যে বিভক্তির দেয়াল রচনা করেছে। সন্দ্বীপবাসীর অর্থায়নে এখানে গড়ে উঠেছে দুটি মসজিদ মক্তব। বাচ্চাদের ধর্মীয় শিক্ষা দেয়া হয় মসজিদ গুলোতে। সন্দ্বীপ এসোসিয়েশান এবং সন্দ্বীপ ইডুকেশন এন্ড কালচারাল সোসাইটি দুটি সংগঠন এখানে গড়ে উঠেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে লালন করে। রাষ্ট্রীয় যে সব গুরুত্¦পুর্ণ দিবস আছে যেমন আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস ২১ শে ফেব্রুয়ারী, মহান স্বাধীনতা দিবস ২৬ শে মার্চ, ১৬ই ডিেেসম্বর আমাদের বিজয় দিবস যেগুলো আমাদের দেশের জাতীয় দিবস হিসাবে স্বীকৃত। সব দিবসগুলো এই দুটি সংগঠন অত্যান্ত জাকযমকের সাথে উদযাপন করে থাকে সবসময়। কখনও কখনও বিশেষ করে ঝঁসসবৎ এর সময় এখানে সুবিশাল ষ্ট্রিট ফেয়ার এর আয়োজন হয়। নিউইয়র্ক সিটি থেকে অনুমতি নিয়ে রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে এখানে বিশাল মেলার আয়োজন করা হয় প্রতিবছর। বাংলাদেশের সেরা শিল্পীদের এখানে নিয়ে আসা হয় এখানে পারফর্ম করার জন্য। বিশেষ কোন গুরুত্বপূর্ণ দিবসে দেশের সেরা কোন ব্যক্তিত্বকেও আমন্ত্রন জানানো হয়। যেমন কোন মন্ত্রী বা সরকারী কর্মকর্তা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কোন নামীদামী লেখক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বকে এখানে আমন্ত্রন জানিয়ে নিয়ে আসা হয়। এমনকি ধর্মীয় অনুভুতিকেও যথাযথ মর্যাদার সাথে এখানে প্র্যাকটিস করা হয়। মুসলমানদের গুরুত্¦পুর্ণ ধর্মীয় উৎসব যেমন পবিত্র রমজান শেষে ঈদুল ফিতর উদযাপন, ঈদুল আযহা, শবে বরাত, শবে কদর এখানে খুব উৎসব মুখর পরিবেশে পালন করা হয়। হাজার হাজার বাঙ্গালী ধর্মপ্রান মুসলমানেরা এতে অংশ নেয় এক সাথে। কখনও কখনও রাস্তাবন্ধ করে অনুমতি নিয়েই রাস্তার উপর একদম বাংলাদেশের আদলে ঈদের সুবিশাল জামাত অনুষ্ঠিত হয়। আর তখন মনে হয় একটি বৃহত্তর বাংলাদেশের প্রতিকৃতি এই নিউইয়র্ক মহানগরে। মোটামুটি সব মিলিয়ে নিউইয়র্কের সন্দ্বীপবাসী জীবন জীবিকার তাগিদে এখানে এসে অনেক সংগ্রাম করে বলতে গেলে প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে যে দেশে প্রায় ৬ মাস বরফ আর কনকনে শীত তাপমাত্রা থাকে হিমাংকের সর্বনি¤েœ অর্থাৎ শুন্য ডিগ্রিতে এমন প্রতিকুল অবস্থা মোকাবেলা করে টাকা রোজগার করে নিজের সংসার, ছেলেমেয়েদের পিছনে ব্যয় করে আবার সেই টাকা থেকে দেশে রেখে আসা ভাই বোন মা বাবার জন্যও পাঠাতে হয়, এমনকি নিজেদের আত্মীয় স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশীর সুখে দু:খে প্রবাসী সন্দ্বীপবাসীরা টাকা পয়সা পাঠিয়ে মানুষের পাশে দাড়ানোর চেষ্টা করে। সন্দ্বীপের প্রায় সব ইউনিয়নের মানুষ এখানে বসবাস করছে। ১৩টি ইউনিয়নের আবার ১৩টি আলাদা গ্রাম সমিতিও এখানে আছে। এই সমিতিগুলোর সদস্য কেবল ঐ গ্রামের লোকজন। প্রত্যেক সদস্য হয়ে এই সমিতিতে চাঁদা দেয় বছরে একবার পিকনিক করে। এভাবে তারা প্রচুর অর্থ সংগ্রহ করে সšদ্বীপে নিজ গ্রামের দরীদ্র অসহায় মানুষগুলোকে সাহায্য করে। এই হল মোটামুটি যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সন্দ্বীপবাসীর অবস্থান। আমি আসলে ব্যক্তিজীবনে অনেক বেশী ব্যস্ত একজন মানুষ, নিজের যেই ব্যবসা সেটাতো করতেই হচ্ছে, সাথে রাজনীতি, সমাজনীতি এবং লিখালিখিতে আমাকে প্রচুর সময় দিতে হয়। নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকাগুলোতে নিয়মিত লিখতে হয়। এরি মধ্যে আমার ¯েœহভাজন ভাইপো ডাক্তার ফিরোজ রুমী আলম যার সাথে আমার প্রতিনিয়ত যোগাযোগ হয়, সে অনুরোধ পাঠিয়েছে সন্দ্বীপ ডেভেলাপমেন্ট ফোরামের ম্যাগাজিনে লিখা পাঠানোর জন্য। তাকে অনেক ধন্যবাদ। ধন্যবাদ ফোরামের আমার শ্রদ্ধাভাজন নেত্রীবৃন্দকে। আপনারা সকলে ভাল থাকবেন, নিরাপদ থাকবেন এমন প্রত্যাশায় আপাতত বিদায় নিলাম।
ধন্যবাদ।
মোহাং সামছুদ্দীন আজাদ
যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সন্দ্বীপবাসী
সহ্-সভাপতি যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামীলীগ।
ফোনঃ ৯১৭-৩৩৫-৪১৮৪