সাইফুল ইসলাম আরেফিন
টরোন্টো, কানাডা।
যতই জানি না কেন লিখার হাত ভালোনা আমার, তবুও লিখতে হচ্ছে। কারণ জীবনে কিছু মানুষ আছেন যাঁদের অনুরোধ কে ইগ্নোর করা যায়না। অথবা তাঁদের অনুরোধ কে নির্দেশ হিসেবেই ধরে নিতে হয়। আমার বেলায় ও তাই হয়েছে।
ষোল বছর ধরে পরিবার সহ কানাডায় বসবাস। যদিও ডাইভার্সড কান্ট্রি তারপর ও একটা কমন নিয়মে চলে সবকিছু। অনেক কিছুর পাশাপাশি এই দেশের অন্যতম সুন্দর ব্যাপার হলো এই ডাইভার্সিটি। কিছু খন্ডচিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
অপরিচিত হলেও রাস্তায় কিংবা পার্কে যে কারো সাথে অভিবাদন জানিয়ে কিছু সময় কথা চালিয়ে যাওয়ার প্রাক্টিস এখানে থেকেই রপ্ত করেছি। হাই হ্যালো হওয়ার পর সাধারণত আবহাওয়া কিংবা বাচ্ছাদের নিয়ে গল্প বেশি হয়। আর এদের নিজেদের মধ্যে নিজ নিজ কুকুর নিয়েও গল্প চলে। সিনিয়র সিটিজেন হলেতো কথাই নাই। আপনি হাই বললেই দীর্ঘক্ষন আপনাকে আটকিয়ে অনেক গল্প করবে। সন্তানদের গল্প, নাতি নাতনি দের গল্প, জীবনের গল্প।
যে কোন অফিস, কলেজ অথবা শপিং মলে একজন আরেকজনের জন্য দরজা ধরে রাখার বিষয়টা ইনভেরিয়েবলি দেখা যায়। সবাই ‘মে আই হেল্প ইউ’ এটিচুডে থাকে।
প্রথম যেদিন পুলিশ আমার গাড়ি থামালো সেদিন খুব নার্ভাস ছিলাম। এরা পেছন থেকে লাইট অথবা সাউন্ড দিয়ে থামায়। তাকিয়ে দেখলাম একজন সাদা একজন কালো। উঠে তাদের গাড়ির দিকে যেতে চাইলাম। ইশারা দিয়ে আমাকে আমার ড্রাইভার সিটে বসে থাকার নির্দেশ দিলো। কালো জন আসলো আমার কাছে এবং আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করলো আমাকে থামানোর জন্য। তাকে জানতে দিলাম যে আমি নার্ভাস কারণ প্রথম কোন পুলিশ আমাকে থামালো। সে আমাকে এস্যুর করলো নাথিং টু বি ওরিড। জানতে চাইলাম আমার প্রবলেম কি ছিলো। বললো তুমি ওয়াইড ইউ টার্ন করেছ যেটা সেইফ না। তবে সেজন্য কোন ফাইন করা হচ্ছেনা।
আমার সামনের একটা টায়ারের কি একটা ভুল ধরে আমাকে ১২০ ডলারের একটা টিকেট দিলো। করণীয় জিজ্ঞাসা করতেই বললো তুমি আমার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কেইস ফাইল করে কোর্টে যেতে পার। এবং পাঁচ মিনিট ধরে আমাকে শিখিয়ে দিলো কিভাবে তার নিজের বিরুদ্ধে আমি কেইস করবো। এমেইজিং এন্ড এস্টোনিশিং এট দ্য সেইম টাইম।
আট মাস পর কোর্টের ডেইট মত গেলাম। শুনানি শেষে বিচারক অর্ধেক জরিমানা মওকুফ করে আমার কাছে জানতে চাইলো পরিশোধ করতে কিস্তির প্রয়োজন আছে কিনা, থাকলে কয় কিস্তি। আমি দুইটির অনুমতি নিয়ে আদালতকে ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে এলাম।
প্রথম জুমার নামাজ পড়তে গেলাম আই এম ও (রহঃবৎহধঃরড়হধষ সঁংষরস ড়ৎমধহরুধঃরড়হ) মসজিদে। পুরুষ মহিলার সংখ্যা ফিফটি ফিফটি বলে মনে হলো। প্রথমবার ইংরেজি খুতবা শুনতে পারলাম। মুসলিম বিশ্বের কোন দেশের মানুষ বাকি ছিলো বলে মনে হলোনা। হরেক রকমের চেহারা। বিষয় ছিলো ননমুসলিম ফেলো দের অধিকার। চমৎকার বয়ান করলেন মরক্কো বংশোদ্ভূত সেই স্কলার। ইমাম হামিদ সিলমি।
মসজিদ থেকে বেরিয়ে দেখি বেশ কয়জন মানুষ সবার হাতে হাতে কিছু ফ্লাইয়ার বিতরণ করছে। এবং কথা বলছে। ফ্লাইয়ারে থাকা ছবিগুলির দিকে তাকিয়ে দেখি দুই একটা ছবি বিতরণকারীদের সাথে মিলে যাচ্ছে। দেশি এক ভাইকে জিজ্ঞাসা করলাম ব্যাপারটা। বললেন এরা নিজেরাই বিভিন্ন পার্টি থেকে এম পি পি কেন্ডিডেইট। একসাথে হয়ে নিজেদের ফ্লাইয়ার নিজেরাই দিচ্ছে। চিন্তার জগৎ নড়ে ওঠলো একটু।
এবসল্যুট ভালো বলতে এই জগতে কিছু নাই। কিছু খারাপ অভিজ্ঞতা ও অবশ্য আছে। তখন আমি টরোন্টোর বাহিরে অপেক্ষাকৃত কম ডাইভার্সড সোসাইটিতে মোভ করে যাই দু বছরের জন্য। অন্টারিও আর ব্রিটিশ কলম্বিয়ার মাঝামাঝি প্রদেশ এটি। সাসকাচুয়ান প্রদেশের সাস্কাটুন শহর। এরা কিছুটা লেস টলারেন্ট।
একজন সাদা যুবক একদিন আমার ইমার্জেন্সিতে রাখা গাড়ির উপর বিরক্ত হয়ে ফর নাথিং আমার ড্রাইভার সাইডের ডোর খুলে আবার এত জোরে লাগালো যে সেটি অকেজো হয়ে গেলো। খুব বেশি তুষারপাত হচ্ছিলো সেদিন। তারপর ও গাড়ি থেকে নেমে ইতিমধ্যে ছেড়ে যাওয়া তার গাড়ির প্লেট নম্বর অনেক কষ্টে উদ্ধার করলাম।
এক হাতে বাম পাশের দরজাটি ধরে আরেক হাতে গাড়ি চালিয়ে বাসায় গেলাম। সিটি পুলিশকে কল করলাম কমপ্লেইন করার জন্য। তারা বললো রাত এগারোটার মধ্যে তাদের অফিসে গিয়ে লিখিত অভিযোগ করতে হবে। মাইনাস থার্টি আউটসাইড। তারপর ও গেলাম। ফরমালিটিস শেষ করে বাসায় ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেলো।
কিছুদিন কেটে গেলেও কোন একশন নজরে পড়লোনা। শুধু ঘটনার এক সপ্তাহ পর সিটি পুলিশ থেকে আমি নিরাপদ আছি কিনা এই প্রশ্ন সম্বলিত একটি ফোন কল ছাড়া। আরও কিছুদিন কেটে গেল, আমিও ভুলে যেতে থাকলাম। বহুদিন পর, মনে হয় দু মাস হবে এক ছুটির দিনে সকাল নটায় আমার জানালা দিয়ে দেখলাম বাসার সামনে পুলিশের গাড়ি। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দরজায় নক করলো। পুলিশের ভয় অনেক আগেই কেটে গেছে বাই দ্য ওয়ে। বরং যে রাস্তায় পুলিশের গাড়ি দেখি সে রাস্তায় তত সেইফ ফিল করি আনলাইক আওয়ার কান্ট্রি।
এনিওয়েজ দরজা খুলে দিলাম। অভিবাদন শেষে আসার কারণ জানতে চাইলাম। লিভিং রুমে বসে কথা বলার অনুমতি চাইলো। সোফায় বসে আমাকে সেই গাড়ির ঘটনা মনে করিয়ে দিলো। বুঝলাম কিছু পজিটিভ ডেভেলপমেন্ট আছে আমার পক্ষে।
জ্যাকেট থেকে একটি ইনভেলপ বের করে আমাকে দিলো। বললো এতে বারোটি অলমোস্ট আইডেন্টিক্যাল পিকচারস আছে। ইউ হ্যাভ টু পিক আপ দ্য রাইট পারসন্স ফটো। বললাম এটা তো অলমোস্ট ইম্পসিবল একটা কাজ। আমি তাকে দেখেছিলাম একবার। তাও উইন্টার ড্রেস পড়নে ছিলো আগা গোড়া। বললো জাস্ট মেইক ইউর স্ট্রংগেস্ট গেস। তাই করলাম। সাত কি আট নম্বর ছবি পর্যন্ত গিয়ে বললাম, মনে হয় এইটা। দুজন পুলিশই সমস্বরে বলে ওঠলো, ওয়াও, ইউ পিকড দ্য রাইট ওয়ান। জানতে চাইলাম তাদের নেক্সট স্টেপ কি। বললো উই আর গোইং টু এরেস্ট হিম। আইনের শাসন খুব সুন্দর। বিমোহিত হলাম।
মত প্রকাশের সাধিনতা এখানকার চার্টার অব রাইটস এর এক নম্বরে আছে। “এক্সপ্রেসন অব কনসাইন্স এন্ড রিলিজিওন”। এটি আধুনিক ওয়ার্ল্ড এর সুন্দরতম জিনিস বলে আমি মনে করি। মাঝে মাঝে খ্রিস্টান মিশনারি পুরুষ মহিলারা রবিবার চার্চ শেষ করে আমাদের দরজা নক করে। কিছুক্ষন কথা বলে বাইবেল দিয়ে যায় গিফট হিসাবে। আমিও ইংরেজি কোরান দেই। কোন সমস্যা হয়না।
পাশাপাশি মসজিদ এবং চার্চ এরকম এখানে অনেক। সেক্ষেত্রে জুমার দিন আমরা তাদের পার্কিং লট ইউজ করি আর রবিবার আমাদেরটা তারা কাজে লাগায়।
আমার জ্যামাইকান এক ছাত্রী একদিন ব্রেকটাইমে আমার কাছে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে ডিটেইলস জানতে চাইলো কারণ ব্রেকের আগে আমি কানাডিয়ান হেলথ এথিক্স পড়াতে গিয়ে মেজর রিলিজিওন্স টাচ করেছিলাম। গল্প শেষে সে আমার কাছে কোরান চাইলো। পরেরদিন কলেজে তার জন্য একটা ইংরেজি কোরান নিয়ে যাই। অসম্ভব খুশি হলো মেয়েটি।
ধর্ম বলুন আর কালচার বলুন সবকিছু এখানে অনেক সাচ্ছন্দ্যে প্রাক্টিস করা যায় ব্যাক হোম এর চাইতে। আই লাভ ইট। ডাইভার্সিটি দীর্ঘজীবী হোক এইখানে।
একটা ইন্টারসেকশন আমার গন্তব্য ছিল একদিন যেটা আমার অচেনা। জিপিএস ভালো ইন্সট্রাকশন দিচ্ছিলোনা। তাই গাড়ি থামিয়ে একজন সাদা ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করলাম। সে ডাইরেকশন দেখিয়ে সেই ইন্টারসেকশন দেখতে কতটা আলোকিত, কি কি গাছ আছে সেটাও বলে দিলো।
এরকম অনেক কিছুতে এখনও অভিভূত হই। আনন্দিত হই। উৎসাহিত হই। কেন জানিনা মাঝে মাঝে লজ্জিত ও হই। এখনও অবাক হই।।
লেখক: প্রভাষক, ফার্মা-মেডিকেল কলেজ, টরোন্টো, কানাডা।
৬৪৭৯৬৬৫০৩৪