ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি
~এ বি এম সিদ্দিক চৌধুরী
আমি ১৯৫১ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে সন্দীপ হতে ঢাকায় এসে ১২/এফ আজিমপুর কলোনীতে উঠি। ঐ বাসাটি আমার বড় দুলাভাই স্পেশাল ব্রাঞ্চের অফিসার মুহাম্মদ আমিন উল্যার নামে বরাদ্দ ছিল। আমার আর এক বন্ধু জোয়াদুল করিম (তনু) ও ১৯৫১ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে কুষ্টিয়া হতে ঢাকায় এসে ২/সি আজিমপুর কলোনীতে উঠেন। ঐ বাসাটি তাঁর ছোট ভগ্নিপতি সি,আই,ডি’র অফিসার আবদুস সামাদের নামে বরাদ্দ ছিল। আমাদের এক বছরের সিনিয়র বাগেরহাটের ওয়াজেদ হোসেন ১২/ই, আজিমপুর কলোনীতে তাঁর মামা সি,আই,ডি’র অফিসার সেকান্দর আলি সাহেবের বাসায় থেকে জগন্নাথ কলেজে বি,কম পড়তেন। ম্যাট্রিক পাশ করার পর আমি ও তনু ওয়াজেদ হোসেনের সহযোগিতায় জগন্নাথ কলেজে আই,এ, ভর্তি হই। বিশ¡বিখ্যাত স্থপতি এফ,আর, খাঁনের পিতা খাঁন বাহাদুর আবদুর রহমান তখন জগন্নাথ কলেজের অধ্যক্ষ। আমরা তিনজন এক সাথে কলেজে আসা-যাওয়া করতাম এবং এক সাথে বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলনে আমরা যোগদান করি। জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হয়ে দেখি যে মিঃ জিন্নাহ ও খাজা নাজিমুদ্দিনের উক্তি নিয়ে ছাত্র সমাজ বিক্ষুব্ধ ও দারুনভাবে উত্তেজিত। প্রতিদিন কোন না কোন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মিঃ জিন্নার ও নাজিমুদ্দিনের বাংলা ভাষা বিরোধী উক্তির প্রতিবাদ চলছে। আমরা তিনজন নিজদিগকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারলাম না- ঝাঁপিয়ে পড়ি বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলনে।
সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ ১৯৫২ এর ২১শে ফেব্র“য়ারি প্রদেশব্যাপী সর্বাত্মক হরতাল আহবান করে। সরকার ভীত হয়ে ২০ ফেব্র“য়ারি শেষবেলায় ১৪৪ ধারা জারি করে। এর আগে ৪ঠা ও ১১ ফেব্র“য়ারিতে আন্দোলন-পতাকা দিবস, ছাত্র-ধর্মঘট, তহবিল সংগ্রহ ইত্যাদি কর্মকান্ডও চলতে থাকে। প্রতিটি কর্মকান্ডে আমরা তিনজন অংশগ্রহণ করি। ভাষা আন্দোলনে জগন্নাথ কলেজের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা কখনও ভুলবার নয়। ২১শে ফেব্র“য়ারিতে আমরা তিনজন একত্রে আজিমপুর কলোনী থেকে বের হয়ে কলেজে এসে হাজির হই এবং কলেজ থেকে একটি বড় মিছিল সহকারে বিশ¡বিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনে আমতলায় এসে উপস্থিত হই। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে একের পর এক মিছিল এসে আমতলায় জড়ো হতে লাগলো। ঐ ঐতিহাসিক আমগাছটি এখন নেই। সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মিছিল আসা শেষ হলে গাজীউল হকের সভাপতিত্বে সভার কার্য আরম্ভ হয়। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হবে কি হবে না এনিয়ে ছাত্রনেতারা একের পর এক জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিতে থাকে। অবশেষে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত হয়। প্রথমেই মেয়েদের কয়েকজন মিছিল সহকারে এসেম্বলির দিকে পাঠিয়ে দেয়া হলো। কতদূর যাওয়ার পর তাদেরকে পুলিশ গাড়ীতে করে নিয়ে গেল। আবার আর একদল মিছিল সহকারে রওয়ানা দিতেই তাদেরকেও গাড়ীতে করে অজানা স্থানে নিয়ে গেল। ছাত্রদের মিছিল বের হলে তাদেরকেও নিয়ে যাওয়া হলো। এসময় কলাভবন হতে মেডিক্যাল কলেজের হোষ্টেল পর্যন্ত টিয়ারগ্যাস ও লাঠিচার্জ চলতে থাকে। টিয়ার গ্যাসের ঝাঁজে চোখ দিয়ে অজোরে পানি ঝরতে থাকে- চোখ ঝালাপোড়া করতে লাগলো। আমরা তিন বন্ধু তাড়াতাড়ি পুকুরে যেয়ে চোখে পানি দিতে লাগলাম এবং আইন বিভাগের ডিনের কামরায় আশ্রয় গ্রহণ করলাম। উলেখিত পুকুরটির এখন আর কোন অস্তিত্ব নেই। ঢাকা বিশ¡বিদ্যালয়ের মাঠে যেখানে এখন জিমনিসিয়াম সেখান থেকে পুলিশ হঠাৎ গাড়ী হতে লালপতাকা নামিয়ে গুলিবর্ষণ করলো। সাথে সাথে মেডিক্যালের হোষ্টেলের বারান্দায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লো বরকত- শহীদ বরকত। ছাত্র-জনতা এবার এদিক ওদিক ছুটাছুটি আরম্ভ করলো। এসময় আমি আমার ঐ বন্ধুকে হারিয়ে ফেলি। গুলি হওয়ার সাথে সাথে বিশ¡বিদ্যালয়ের গেইটে অবস্থানরত ডি,আই,জি ওবেদুল্যাকে ছাত্ররা ঘিরে ধরে গুলি করার কারণ জানতে চায় এবং এ নিয়ে তর্কাতর্কি শুরু হয়। এদলে আমিও ছিলাম। এরপর আমি মেডিক্যাল কলেজের ভাঙ্গা দেওয়াল দিয়ে হোষ্টেলে পৌঁছে যাই এবং দেখি যে রক্তের স্রোত বয়ে যাচ্ছে হোষ্টেলের বারান্দায়। সন্ধ্যায় কারফিউ জারী করা হয়। তার আগেই আমি বাসায় পৌঁছে যাই। ২২শে ফেব্র“য়ারি আমি আর বাসা থেকে বের হইনি। ঐদিনই কারফিউ ভঙ্গ করে মিছিল বের হয়।
২২ অথবা ২৩ ফেব্রুয়ারি স্যার সলিমুলাহ মুসলিম হলের ভিতর মাইক লাগিয়ে ছাত্ররা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে উর্দুর তথা সরকারের বিরুদ্ধে একের পর এক জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিতে লাগলো। সাথে সাথে গুলি বর্ষনের বর্বরোচিত ঘটনা, আহত ও নিহতের সংখ্যা স¤পর্কেও বিভিন্ন তথ্য প্রকাশ করতে লাগলো। কিন্তু মাইকে কে বক্তৃতা দিচ্ছে তার নাম ঘোষণা করা হতো না। শুধু বলা হতো “আমাদের এক ছাত্র ভাই এখন বক্তৃতা দিবেন” ইত্যাদি। তবে সন্দ¡ীপ নিবাসী অধ্যাপক আসিফুল হক উর্দুতে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়ে সকলকে অবাক করে দেন। শ্রোতারা মনে করেছে এই ব্যক্তি নিশ্চয় উর্দু ভাষী হবেন। গোয়েন্দারা ছুটাছুটি করতে আরম্ভ করলো ঐ কথিত উর্দু ভাষীর সন্ধানে। আমি সকাল হতে সন্ধ্যা পর্যন্ত মুসলিম হলের মাঠে বসে বক্তৃতা শুনতাম। শুধু মাত্র খাওয়ার সময় বাসায় যেয়ে খেয়ে আসতাম। মুসলিম হলের মেইন গেট ব্যতীত অন্য সব গেইট বন্ধ থাকতো। মুসলিম হলের আবাসিক ছাত্র ব্যতীত আর কাহাকেও ঢুকতে দেয়া হতো না। প্রতিদিন সকাল হতে সন্ধ্যা পর্যন্ত মুুসলিম হলের মাঠে কয়েক হাজার লোক বসে বসে বক্তৃতা শুনতো। হঠাৎ একদিন পুলিশ বাহিনী হলের পিছনের দরজা ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকে কামরায় কামরায় যেয়ে ব্যাপক তল্লাশি শুরু করেন। ঐ অভিযানে আমার ভগ্নিপতিও অংশগ্রহণ করে। হলে ঢুকেই প্রথমে পুলিশ মাইকটি ছিনিয়ে নেয়। আমার ভগ্নিপতি দোতালায় উঠে সন্দ¡ীপের মোদাচ্ছের আহম্মদের রুমে ঢুকে তলাশি শুরু করে। মোদাচ্ছের আহমদের বেডিং এর নীচের থেকে একটি চিঠি উদ্ধার করে। ঐ চিঠিটা মোদাচ্ছের আহমদ তাঁর পিতা সেকান্দর কেরানীর নিকট লিখেছিলেন কিন্তু পোষ্ট করা হয়নি। এ সময় মোদাচ্ছের আহমদ রুমে ছিলেন না। আমার ভগ্নিপতি ঐ চিঠিটি লুকিয়ে ফেলেন। এরপর চিঠিটি মোদাচ্ছের আহমদকে দিয়ে দেয়া হয়। চিঠিটি স¤পূর্ণ সরকার বিরোধী ছিল। ঐ অভিযানে সন্দ¡ীপের কোন ছাত্র গ্রেফতার হয়নি। সন্দ¡ীপের জামসেদ মিয়ার রুমে আপত্তিকর কোন কিছু পাওয়া যায়নি।
২১ শে ফেব্রুয়ারীর আগে ও পরে অধ্যাপক আবুল কাশেমের মালিকানাধীন “আমাদের প্রেসে” রা®ট্রভাষার ওপর বহু আলোচনা হয়েছে। প্রেসটি ছিল শেখ সাহেব বাজার আজিমপুর কলোনীর পাশেই। আমি প্রায় সব আলোচনা সভায় যোগদান করতাম। ঐ প্রেস হতে “সৈনিক” পত্রিকা বের হতো। ভাষা আন্দোলনের ওপর ঐ পত্রিকাটি সঠিক খবর পরিবেশন করতো।
ঐসময় মুসলিম হলে সন্দীপ নিবাসি ছাত্র ছিলেন এ,ডি,এম, মোয়াহেদুল মাওলা (জামসেদ), মোদাচ্ছের আহমদ, ওবায়দুল হক এবং নাম না জানা আরও যারা সন্দীপের ছাত্র ছিলেন তারা প্রত্যেকেই ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
১৯৫২ সালে মুসাপুরের আবদুল আজিজ, পিং-মৃত হাজি আবদুর রাজ্জাক জগন্নাথ কলেজে বি,এ পড়তেন। তিনিও ভাষা আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে অধ্যয়নরত আবদুল মালেক ভাষা আন্দোলনে গৌরবময় ভূমিকা রাখেন। তাকে আমি দেখেছি জগন্নাথ হলের বিপরীত দিকে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের দেয়ালের ওপর দাঁড়িয়ে চুঙ্গা মুখে বক্তৃতা দিতে গুলি হওয়ার পর। ঐ সময় ঢাকা বিশ¡বিদ্যালয়ের, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ও মেডিক্যাল কলেজের বিভিন্ন হলে অবস্থানরত সন্দ¡ীপের ছাত্ররা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে।
২১শে ফেব্র“য়ারির পর ভাষা আন্দোলন ও গুলিবর্ষনের ওপর একটি ম্যাগাজিন বের হয়। তার মধ্যে একটি ইংরেজি প্রবন্ধ ছিল। ম্যাগাজিনের নাম ও স¤পাদকের নাম মনে নেই। এটি সরকার বাজেয়াপ্ত করে। ঐ ম্যাগাজিনের এক কপি আমার কাছে ছিল। এটি পরে আমার ভগ্নিপতি আমার কাছ থেকে নিয়ে যান। এটি সম্ভবতঃ ভাষা আন্দোলনের ওপর প্রথম সংকলন।
১৯৫২ সনে নজরুল ইসলাম ভূইয়া সন্দ¡ীপ হাইস্কুলে দশম শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন, ডাঃ সামছুল আলমও দশম শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন এবং এ,কে,এম, আনছারুল হক নবম শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন, এরা এবং আরও অনেকে সন্দ¡ীপ হাইস্কুলে ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন।
অধুনালুপ্ত সন্দ¦ীপ হাইস্কুলের মাঠের পশ্চিম পাশের্¡ একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়। আমি ও সন্দ¡ীপের ম্যাজিষ্ট্রেট আবদুস ছাত্তারসহ একবার প্রভাতফেরী সহকারে ঐ শহীদ মিনারে পুষ্প অর্পন করি।
আজ থেকে প্রায় ৬০ বছর আগে বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলনে আমার অংশগ্রহণ কোনো আকসি¥ক বা নিছক আবেগতাড়িত ঘটনা ছিল না। মাতৃভাষার মর্যাদা ও বাঙালি জাতির স্বকীয়তা ও স্বাধীন অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনে নিজের বিবেকের তাড়নায় ভাষা আন্দোলন অংশ নিয়েছিলাম।
বিঃদ্রঃ
বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলনের সময় স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ছাত্র-সংসদের সহ-সভাপতি ছিলেন মুজিবুল হক (পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক), প্রভোষ্ট ছিলেন ডক্টর ওসমান গনি। গোলাম মাওলা ছিলেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি। ভাষা আন্দোলনে যুবলীগ ও তমদ্দুন মজলিশ একটু বড়ো ভূমিকা পালন করেছিল। সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই একটা করে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়েছিল। সকলের ওপরে ছিল সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ।
১৬/০১/২০১০
——-
গ্রামের বাড়ি- বাউরিয়া।
সন্দীপের আঞ্চলিক ইতিহাসের অন্যতম প্রতিকৃত।
শ্বাশত সন্দীপসহ বহু গ্রন্থের রচয়িতা।
বিঃদ্রঃ- ভাষা আন্দোলনের উপর তিনি আরও স্মৃতিকথা লিখেছিলেন। বর্তমান নিবন্ধটি জনাব এবিএম সিদ্দিক চৌধুরী বর্তমান দ্বীপের চিঠির সম্পাদকের অনুরোধে ২০১০ সালে তাকে লিখে দেন। লেখাটি এর আগে কোথাও প্রকাশিত হয়নি।