সন্দ্বীপ : বহু বছর আগে পরে – কানাই চক্রবর্ত্তী

April 14, 2025

By Mohd Rumi Alam

সন্দ্বীপ : বহু বছর আগে পরে
কানাই চক্রবর্ত্তী

সন্দ্বীপের নামে তার নাম। পরিচয় হয়েছিল কোলকাতা ফাইন আর্টস একাডেমিতে। আমি নাটক দেখতে গিয়েছিলাম আর সন্দ্বীপ নাটক
করতে। সেই সময়ে কোলকাতার একটি প্রতিষ্ঠিত নাট্যদলের কর্মী সে। সন্দ্বীপ নাম শুনেই আসলে আমি তার সাথে পরিচয়ে আগ্রহী হয়ে
উঠি। আমার খুব কৌতূহল তার আদি পূর্বপুরুষের বাড়ি সন্দ্বীপ ছিল কি-না তা জানতে। আমি নিজেও বাংলাদেশের বিশেষ করে মফস্বলের
একজন নাট্যকর্মী পরিচয় দেয়াতে সন্দ্বীপের নজর কারতে বেশি সময়  না। আমার আগ্রহ সন্দ্বীপকে নিয়ে আর তার বাংলাদেশের বিশেষ
করে মফস্বলের শিল্প সংস্কৃতি আর নাটক নিয়ে। নাটক শেষে তার সাথে কথা হয়। আমি এককথা -দু’কথার পর তার নাম কে রেখেছেন জিঞ্জাসা করি। সে খুব অবাক হয়। আমি এটিও জানতে চাই তাদের পূর্বপুরুষের কারো বাড়ি সন্দ্বীপ ছিলো কি-না। সে উল্টো আমার কাছে জানতে চায় সন্দ্বীপটা কি? আমি বলি সন্দ্বীপএকটা দ্বীপ। বাংলাদেশের চট্রগ্রামে এটি অবস্থিত। এ ব্যাপারে তাকে খুব একটা আগ্রহী দেখা গেলো না। নাম নিয়ে এতো প্রশ্ন করছি কেনো স্বভাবতই বিরক্ত সে। আমি হাল ছাড়ি না। আমার জন্মস্থান সন্দ্বীপ জানিয়ে তাকে বলি কমরেড মুজাফফর আহমেদ যাকে আপনারা কাকাবাবু ডাকেন তার বাড়ি কিন্তু সন্দ্বীপে ছিলো। বাংলা সাহিত্যেও আদিকবি মীন নাথের জন্মস্থানও সন্দ্বীপে। এবার সে একটু উৎসুক হয়। আমাকে বলে বিষয়টি সে বাড়িতে আলোচনা করে জেনে আমাকে জানাবে। তবে সে এটুকু শিওর করে তার এবং তার বাবার বাড়ি সন্দ্বীপ নয়। তারা পশ্চিমবঙ্গেই জন্মগ্রহণ করেছেন। এরপর আমরা যে যার মতো বিদায় নিই। দিন দুয়েক পরে আমি যে বন্ধুটির সাথে নাটক দেখতে গিয়েছিলাম সে আমাকে জানায়, সন্দ্বীপ আমাকে জরুরি ভিত্তিতে খুঁজছে।
আমি আগ্রহ সহকারে তার সাথে দেখা করি। এ দেখায় অনেক বেশী নৈকট্য দেখায় সন্দ্বীপ। আমাকে দেখেই আবেগে বলে সেও সন্দ্বীপের
লোক। ঘটনার বিবরণ এই তার দাদুর বাড়ি ছিলো সন্দ্বীপে। তরুণ বয়সে তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন এবং এখানে প্রতিষ্ঠিত
হন। প্রিয় জন্মস্থান সন্দ্বীপ ছেড়ে আসলেও তার প্রতি অনুরাগ আগের মতোই আছে। তারই অংশ হিসেবে তিনি নাতির নাম রাখেন সন্দ্বীপ।এ পর্যয়ে আমাকে বলে তার দাদু অনুরোধ করেছেন আমি যেন একবার সন্দ্বীপের দাদুর সঙ্গে দেখা করি। উনি আমাকে খুব করে দেখতে
চেয়েছেন। আমাকে দেখলেই নাকি সন্দ্বীপ দেখা হয়ে যাবে। আমি অনুরোধটি রক্ষা করবো বলে কথা দিই। তবে শর্ত দিই আমাকে নিয়ে
যেতে হবে।
আমি তখন সাংবাদিক-টাংবাদিক কিছুই না। তারপরেও আমার মধ্যে একটি কৌতূহল কাজ করে এই ব্যক্তিটি কোন প্রেক্ষাপটে কিংবা
কোনো বাস্তবতায় জন্মস্থান ত্যাগ করেছিলেন ।
এক সময় সন্দ্বীপ আমাকে তাদের বাড়িতে নিয়ে যায়। বাড়িটি দেখেই বোঝা গেলো তারা মোটামুটি অবস্থাসম্পন্ন। আপ্যায়নেও
সন্দ্বীপের সংস্কৃতি। অবস্থা দেখে মনে হলো মধ্যবিত্তের চেয়েও অবস্থা তাদের ভালো। দাদু একসময় কোলকাতা পোর্টে চাকরি করতেন। বহু বছরআগে অবসর নিয়েছেন। এখন পেনসন ভোগী। সন্দ্বীপের বাবা সরকারি চাকরিজীবি। তারা এক ভাই, এক বোন। বোন বড়। কোলকাতা
বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে এমএ করছে। তবে একটা বিষয় লক্ষ্যণীয় বাড়িতে সন্দ্বীপের দাদু ছাড়া সন্দ্বীপ নিয়ে কারো কোনো
উচ্ছ্বাস নেই। তিনি অনর্গল জন্মস্থান নিয়ে কথা বলছেন। মুছাপুর মাইটভাঙ্গার মধ্যবর্তী স্থানে তাদের বাড়ি ছিল। খুটিয়ে খুটিয়ে সব
জিজ্ঞেস করছেন। বাতেন সওদাগরের গল্প করছেন। তার ছেলে সন্দ্বীপের এমপি ছিলেন শুনে খুশি হলেন। সন্দ্বীপ থেকে আসা তার এক বন্ধুরমাপদ দাস বিশ্ব ভারতীর ভিসি হয়েছেন এ খবরটিও গর্বের সাথে জানালেন তিনি। বুকের গহীন থেকে খুব বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অতপর জানতে চাইলেন সন্দ্বীপের মানুষ কেমন আছেন। হিন্দুরা কি এখনো দেশ ত্যাগ করেন। আমি কিছুই বলি না। পাল্টা আক্রমণ করি, আপনারা কেনো সন্দ্বীপ ছাড়লেন? বিস্ময়ে তিনি যেন কিছুক্ষণ বিমূঢ় হয়ে গেলেন। এ রকম একটা স্পর্শকাতর প্রশ্ন তাকে আমি করতে পারি তিনি বোধ হয় স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি। ছল ছল চোখে আমার দিকে তাকালেন। আবারও দীর্ঘশ্বাস। এমনভাবে বললেন নিজের মনে নিজেই কথা বলছেন। কষ্ট করে তার কথার যা মর্মার্থ দাঁড়ালো তা হচ্ছে পাপ। ‘পাপ না করলে কেউ কি জন্মস্থান ত্যাগ করে?’
দাদু কিছুক্ষণ বিরতি নেন। তারপর খুলে দেন পেন্ডরার বাক্স। বাক্স থেকে এক একটা তথ্য বের হয়, আমি চমকিত থেকে আরো চমকিত হই।
আমার তৃতীয় চোখে একেকটি দৃশ্যকাব্য যোগ হয়। এই তৃতীয় চোখ দিয়ে যা শুনলাম, উপলব্দি করলাম তা এ লেখায় উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই মনে করছি। জীবনান্দ দাশের মতো আমিও বলতে চাই ‘কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে।’ দেশ বিভাগ
নিয়ে যারা গবেষণা করেছেন তারা এগুলো আরো সুন্দরভাবে লিখেছেন। অনেকেই এ বিষয়ে জানেন। দাদুর বক্তব্যে সেগুলোরই প্রতিধ্বনি
হয়েছে মাত্র।
প্রিয় পাঠক, ক্ষমা করে দেবেন। উপরে আমি যে গল্পটি বলেছি একেবারেই কাল্পনিক। কোলকাতায় সন্দ্বীপ নামে আমি অনেককে
পেয়েছি। কিন্তু কারো বাড়িতে আমি কষ্মিনকালেও যাইনি। সন্দ্বীপ এবং তার দাদু আমার সৃষ্টি। সন্দ্বীপ ত্যাগী কোনো মানুষকে আমি
কোনদিন জিজ্ঞাসা করিনি আপনারা সন্দ্বীপ ত্যাগ করলেন কেনো? কারণ, প্রেক্ষাপট বা প্রকৃত সত্যটা উপলব্দি করা যায়। সেই কল্পনা
শক্তি আমার আছে বলে মনে করি। আসলে আমি এখন যে লেখাটি লিখবো তার একটি প্রেক্ষাপট খুঁজছিলাম। না পেয়ে অবশেষে নিজেই একটি কাল্পনিক প্রেক্ষাপট তৈরি করে নিলাম। সাহিত্যের বিচারে এটি কোনো অপরাধ নয়। তবে এটি আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি ভবিষ্যতে সন্দ্বীপ ত্যাগী পশ্চিমবঙ্গে প্রতিষ্ঠিত বা অপ্রতিষ্ঠিত (যারা দেশ ভাগের পর গেছেন) কোন ব্যাক্তি বা পরিবারকে(বাংলাদেশের যে কোন প্রান্তের) যদি কেউ তাদের জন্মভ’মি ত্যাগের কারণ জানতে চান তাহলে কল্পিত সন্দ্বীপের দাদুর পেন্ডেরার বাক্স থেকে যা বের হয়েছে তাই শুনবেন। আমার একটি লেখা ‘রহিমের মা রূপবান এবং সন্দ্বীপের নৌপথ ’ সামাজিক গণমাধ্যম এফবিতে দেয়ার পর একজন পাঠক মন্তব্য করেছিলেন ‘আসলে ত্রিশ বছর আগে বা আরো আগে সন্দ্বীপ অনেক ভালো ছিলো’। তাৎক্ষণিকভাবে বিষয়টি আমি আমলে নেইনি।
অর্বাচীন এবং আবেগতাড়িত হয়ে মন্তব্যটি করেছিলেন বলে ধরে নিয়েছিলাম।কারণ,শুধুমাত্র সেই সময়ে সংগঠিত অপ্রীতিকর
কয়েকটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে এতো বড় একটা বিষয়ে মন্তব্য করা বা মিমাংসায় পৌঁছানোর জন্য তার কাছে কি তথ্য-উপাত্য ছিলো
আমার জানা ছিলো না। মন্তব্যকারীও তা উপস্থাপন করতে পারেননি। আমরা যদি এ ধরনের মিমাংসায় পৌঁছতে হয় তা হলে আমাদের আগে ত্রিশ বছরের বা আরো আগের এবং বর্তমান সময়ের আর্থ-সামাজিক অবস্থার একটি তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরতে হবে। আর বুঝতে হবে উন্নয়ন মানে শুধু রান্তা-ঘাট, স্কুল-কলেজ নির্মাণ নয়। মেধা, মনন, অর্থনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য, সামাজিক অগ্রগতি, সোহার্দ্য, সম্প্রীতি, ধর্মীয় অসাম্প্রদায়িকতা, যোগাযোগ ব্যবস্থা, নারী শিক্ষা , রাজনীতি, গণতন্ত্র, উৎপাদন, সম্পদ, সবকিছুই হচ্ছে উন্নয়নের সূচক। এই নিরিখেই বিচার করতে হবে আসলে আরো বিশেষ করে পাঁচ বা ছয়দশক আগে সন্দ্বীপ আরো উন্নত ছিলো নাকি ছিলো না। যদিও মন্তব্যকারি বলেছিলেন ত্রিশ বছর আগের কথা ।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে ত্রিশ বছর আগে কেনো কিংবা দেশ বিভাগের পর থেকে কেনো নয়? আগে-ভাগে বলে রাখছি, এ রকম একটা
পরিসংখ্যান বের করা চাট্টিখানি কথা নয়। এটি একটি গবেষণার বিষয়। এর জন্য প্রয়োজন সময় এবং জনবল। জনবল বলতে আমি
বুঝিয়েছি মেধাসম্পন্ন কয়েকজন গবেষকের। তবে আমরা একটা সাধারণ সূচকে কিছু কিছু সেক্টরের তুলনাটা তুলে ধরতে পারি। যদিও তা বিজ্ঞানভিত্তিক নাও হতে পারে। যেমন এখন যে ঘটনাগুলো ঘটছে তা অতীতে ঘটেছিল কিনা কিংবা অতীতে যা হয়েছিল তা এখন হচ্ছে কিনা তা তুলনা করে।ত্রিশ বছর আগে কিংবা দেশ বিভাগের আগে রাজনীতি কেমন ছিলো, এখনও মানুষ জন্মভ’মি ত্যাগ করে কিনা অথরা এখন বর্তমানে কি
অবস্থায় আছে। একইভাবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মূল্যবোধ নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা করা যেতে পারে। কিন্তু সম্পূর্ণ আলোচনা বা উপসংহারে
পৌঁছার মতো অবস্থানে যাওয়া সম্ভব হবে না। দেশ বিভাগের আগে ও পরে সন্দ্বীপের আর্থ-সামাজিক অবস্থা কেমন ছিলো তা সন্দ্বীপের দাদুর গল্পের মধ্যদিয়েই বলার চেষ্টা করছি। অর্থাৎ, সে সময়ে সাম্প্রদায়িকতা ছিলো, অন্যের ভিটেমাটির ওপর একটা শ্রেণীর লোভ-লালসা ছিলো। একটা বিশেষ শ্রেণীর লোজনদের মধ্যে দেশত্যাগের একটা হিড়িক ছিলো। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মতো ঘটনা যে ছিলো বিপ্লবী লালমোহন সেন তো উদাহরণহিসেবেই আছেন। উল্টো পিঠে আবার সেসময়ে ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং সহিষ্ণুতার বিষয়টিরও জোড়ালো উপস্থিতি ছিলো। এ রকম একটি মূল্যবোধের উদাহরণ এখানে অবতারণা করছি। এটা অবশ্য আমি আমার বাবার মুখে শুনেছি। আমার দাদু ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ এবং এ উপমহাদেশের একজন নামকরা পন্ডিত। তিনি একজন শিক্ষকও ছিলেন। এই দাদু যখন রহমতপুরে বাতেন সওদাগর সাহেবের গদির সামনে দিয়ে যেতেন তখন তিনি প্রায় সময় দাদুকে গদিতে আমন্ত্রণ করে নিয়ে যেতেন। বের হওয়ার সময় হাতে ধরিয়ে দিতেন আম, কলা বামৌসুমি ফল। সওদাগর সাহেব জানতেন দাদু নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ। তিনি তো আর গদিতে বসে চা সিঙ্গারা অথবা বিড়ি-সিগারেট খাবেন না এবং কারো হাতে কাটা ফলও মুখে তুলবেন না। তাই আস্ত ফল দাদুর হাতে তুলে দিয়েই সম্মান জানাতেন তিনি। পর ধর্ম ও আচারের প্রতি এই শ্রদ্ধাবোধটা তখন প্রবলভাবে যে ছিলো তার আরো অনেক প্রমাণ ইচ্ছে করলে দেয়া যাবে ।

দেশ ভাগ কিংবা পাকিস্থান সৃষ্টির পর সন্দ্বীপের আর্থসামাজিক অবস্থার বিবরন আমার পক্ষে আর বেশী দেয়া সম্ভব নয়। তবে যতটুকু ধারনা করা যায় তখনকার মানুষের শ্রেণী চরিত্র ছিল বেশির ভাগেই সাধারন এবং প্রান্তিক। জোতদার এবং ছোট খাট জমিদার শ্রেনির অল্পসংখ্যক উপস্থিতি থাকলেও তাদের দ্বারা সাধারণ মানুষের নিপিড়ন হওয়ার তেমন কোন খবর চাউর নেইু। বাংলাদেশ সৃষ্টির আগ পর্যন্ত এই অবস্থা
অব্যাহত ছিল। এখনকার মত এত বেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না থাকলেও শিক্ষা এবং সংস্কৃতির ভিতও মজবুত ছিল। যোগাযোগ ব্যাবস্থা এখনকার
চেয়েও খারাপ থাকলেও হেলিকপ্টার সার্ভিস পেয়েছেন সন্দ্বীপের মানুষজন। লোকসংখ্যা অনেক কম ছিল। রেমিটেন্স তেমন ছিলনা। তবে
বিদেশী জাহাজে চাকরীর সুবাদে অনেক সৌখিন জিনিসের সাথে সন্দ্বীপের মানুষের পরিচয় ছিল। আমি আগেই বলেছি‘ ত্রিশ বছর আগে
সন্দ্বীপ ভালো ছিল মন্তব্যটি করা হয়েছিল সন্দ্বীপের গুপ্তছড়া –- কুমিরা ঘাটে একটি দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে। এখানেও বলা যায় ত্রিশ বছর আগে কিংবা আরো আগেও সন্দ্বীপের নৌপথে দুঘটনা বা প্রাণহানির ইতিহাস আছে। বাদুরা জাহাজ ডুবি এবং প্রচুর লোকের প্রাণহানির
ঘটনা এখনো সন্দ্বীপের লোকের ভুলার কথা নয়। পরবর্তি সময়ে সত্তর এবং আশির দশকেও লঞ্চ এবং ট্রলার দুর্ঘটনায় অনেকের প্রান গেছে।
বাংলাদেশ স্বাধীনের পর থেকে নব্বই দশক পর্যন্ত সন্দ্বীপের আর্থসামাজিক অবস্থা আমরা যদি মোটা দাগে অবলোকন করি তাহলে বর্তমানে সন্দ্বীপ যে অবস্থায় দাঁড়িয়েছে তার সূচনা লগ্ন ছিল কিন্তু কয়েক দশক আগেই। যার অনেক কিছুই এখনো অব্যাহত আছে। পঞ্চাশ
বা ষাট দশকে সন্দ্বীপের মানুষ দ্বীপ ত্যাগ করা শুরু করেছিলেন। পরের দশকগুলোতেও কিন্তু এ ধারা অব্যাহত ছিল এবং আছে। তখন একধরনের প্রেক্ষাপটের কারনে বিশেষ শ্রেনির লোকজন সন্দ্বীপ ছেড়েছে আর নব্বই দশকের পর থেকে সব শ্রেণির লোকজনেই ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সন্দ্বীপ ছেড়েছে এবং ছাড়ছে। অবশ্য এর কারণ যতটুকু রাজনৈতিক ততটুকু প্রাকৃতিকও। নদী ভাঙ্গণে নিঃশেষ হয়ে যেমন অনেকে সন্দ্বীপ ত্যাগ করছেন তেমনি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের হামলা – মামলার ভয়েও অনেকে অন্যত্র গিয়ে আশ্রয়ে নিয়েছেন । এর সাথে অবশ্য আর একটি বিষয়ের যোগ আছে। সেটি রুটিরুজি। এ লক্ষ্যে তারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই ছড়িয়ে পড়ছে। এখানে আমি বলতে চেয়েছি সন্দ্বীপের লোকজন এখন যেমন দ্বীপ ত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছেন তেমনি ত্রিশ বছর আগে কিংবা আরো কয়েক দশক আগেও তারা বাধ্য হয়েছিলেন । তখন ছিল এক শ্রেণি, এখন সব শ্রেনির। দেশ ত্যাগের জন্য তখন চোখ রাঙ্গাতো একটি শক্তি আর এখন প্রকৃতি রাজনীতি ও জীবিকা । পার্থক্য এটুকুই। আগে বিশেষ একটি শ্রেণির মানুষের ভিটে মাটির প্রতি লোভ দেখা গেলেও এখন সার্বজনীন। এই চিত্রটি অবশ্য সন্দ্বীপ নয় সারা দেশে আরো ভয়াবহ ।
সন্দ্বীপে মাঝে মধ্যে চুরি ডাকাতির কথা শুনা যায়। ত্রিশ বছর আগেএরকম না হলেও চুরি ডাকাতি ছিল। এখন যেমন কলংকজনক ঘটনা
ঘটছে অতীতে ঘটেছে । ত্রিশ বছর আগে কিংবা আরো আগে সন্দ্বীপে এত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিলনা। এখন ৪০টিরও বেশী মনে হয় হাই
স্কুল আছে। এর মধ্যে মেয়েদের জন্যই আলাদা স্কুল তিনটি। সত্তর দশকে যেখানে কলেজ ছিল মাত্র একটি, সেখানে সরকারি একটি সহ মোট কলেজের সংখ্যা ছয়টিরও বেশী। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোতে ছাত্রীর সংখ্যাও প্রায় ছেলেদের সমান। অর্থাৎ নারী শিক্ষাায়ও যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। ত্রিশ বছর আগে দেশের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় / মেডিকেল কলেজে কিংবা ইনিঞ্জনিয়ারিং পড়া ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ছিল হাত গোনা। এখনতো গুনেও শেষ করা যায়না। একইভাবে এসব প্রতিষ্ঠানে সন্দ্বীপে জন্মগ্রহনকারি শিক্ষকদের সংখ্যাও বেড়েছে অনেক বেশী। কিছুদিন আগেও (২০০৬-২০০৮) প্রশাসনে পূর্ণসচিব ছিলেন ছয়/সাত জন।যুগ্ম ও সহকারি সচিব ছিলেন আরো বেশি। এভাবে সকল
পেশায় সন্দ্বীপের লোকের সংখ্যা বেড়েছে। এটা কি এখনকার সময়ের অগ্রগতি নয় ? বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে সন্দ্বীপের একজন
উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করছেন ( ফাওজুল কবির খান)। এর আগে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব পালন করেছেন সন্দ্বীপেই জন্মনেয়াঁ একজন (কাজী হাবিবুল আউয়াল)। তাঁদের এই দায়িত্ব পালন সন্দ্বীপবাসী নিশ্চয় গর্ব মনে করেনা ? শুধু বাংলাদেশেই নয় বহি:বির্শ্বের মানুষ তাদের জানতে পারছেন। প্রায় আশির দশক পর্যন্ত সন্দ্বীপের কোন শিল্পপতির নাম শুনা যায়নি। কিন্তু বর্তমানে গার্মেন্টস
শিল্প ছাড়াও অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিক সন্দ্বীপের লোকজন। জাতীয়ভাবে বিভিন্ন পেশাজীবি সংগঠনেও সন্দ্বীপের মানুষ নেতৃত্ব
দিয়েছেন এবং দিচ্ছেন। নব্বই দশকে জাতীয়ভাবে আফলাতুন নামে শুধুমাত্র একজন সাংবাদিকের নাম জানা যেতো। বর্তমানে প্রায়
আট/দশজন সুনামের সাথে সাংবাদিকতা পেশায় জড়িত আছেন। আমরা সবাই জানি সন্দ্বীপের প্রচুর লোকজন বর্তমানে বিশে^র বিভিন্ন
স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। সেখানেও বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তোলে সন্দ্বীপকে পরিচিত করছেন।
অতীতের তুলনায় তাঁরা প্রচুর পরিমান রেমিটেন্স পাঠিয়ে বাংলাদেশেল অর্থনীতিকে স্ফীত করছেন। নির্মোহভাবে বিচার বিবেচনা করলে দেখা যাবে গত কয়েক দশকে সন্দ্বীপেও অবকাঠামোগথ প্রচুর উন্নয়ন সাধীত হয়েছে। এটাও ঠিক উন্নয়ন মানে শুধু অবকাঠমোগত উন্নয়ন
নয়। উন্নয়নের পাশাপাশি মনবিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ অনেকটাই কমেছে। অনেকটা এরকম ‘বিঞ্জান দিয়েছে বেগ ,কেড়ে নিয়েছে
আবেগ’ এরকম আরকি। মনে রাখতে হবে সন্দ্বীপ একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হলেও বাংলাদেশের বাইরে নয়। বাংলাদেশের সব প্রান্তেই যেসব ঘটনা ঘটছে( সামাজিক , রাজনৈতিক) , তার ছিদফোঁটা হলেও সন্দ্বীপকে স্পর্শ করবে এটাই স্বাভাবিক। আসলে পৃথিবীর ইতিহাস হলো অগ্রগতির ইতিহাস। কিছুনা কিছু সূচকের উন্নয়ন হবেই। তারপরেও আজ থেকে ত্রিশ বছর পরে আর একজন পাঠক যে বলে উঠবেন না ‘ ত্রিশ বছর আগের সন্দ্বীপ আরো ভালো ছিল, তার কি কোন গ্যারান্টি আছে ?

লেখকের গ্রামের বাড়ি পুরনো সন্দ্বীপ টাউন। বর্তমানে ঢাকায় থাকেন। সাংবাদিক। সাবেক নগর সম্পাদক বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) ।
লিখিত ও মঞ্চস্ত নাটক ত্রিশটিরও বেশি।
প্রকাশিত গ্রন্থ : আনন্দের মুক্তি চাই (ছয়টি নাটকের সমষ্টি), মহড়া ও
অন্যান্য নাটক ( চারটি নাটকের সমষ্টি) , ইতিহাসে নেই (উপন্যাস)
এবং রির্পোটিং নিয়ে একটি গ্রন্থ।

*.২০২৪ সালে ঢাকাস্থ সন্দ্বীপ ডেভেলপমেন্ট ফোরামের বার্ষিক ম্যাগাজিন ‘দ্বীপের চিঠি-১০ এ প্রকাশিত।

Related Posts

জমির খতিয়ান – মোহাম্মদ মোশারেফ হোসেন জগলু

জমির খতিয়ান – মোহাম্মদ মোশারেফ হোসেন জগলু

জমির খতিয়ান কি: জমির খতিয়ান বলতে মৌজা ভিত্তিক এক বা একাধিক ভূমি মালিকের ভূ-সম্পত্তির বিবরণ। যে ভূমি রেকর্ড জরিপকালে এক বা একাধিক ভূমি।মালিকদের সম্পত্তির বিবরণ প্রস্তুত করা হয় তাহাকে খতিয়ান বলে। খতিয়ানে ভূমি অধিকারীর নাম ও প্রজার নাম,জমির দাগ নাম্বার, পরিমাণ, জমির...

read more
’শিকড়’ বইয়ের সম্পাদকের বক্তব্য

’শিকড়’ বইয়ের সম্পাদকের বক্তব্য

জনাব ডাঃ রুমী আলম, আচ্ছালামুয়ালাইকুম। আমাদের পারিবারিক ইতিহাস নিয়ে রচিত শিকড় বইটির আপনার প্রেরিত রিভিউটি পেয়ে অত্যন্ত খুশি ও আনন্দিত হয়েছি। গভীর মনোনিবেশ সহকারে বইটি পড়ে আপনার সুচিন্তিত মতামত জানানোর জন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা। পেশাগত দায়িত্ব পালন করার...

read more